ঢাকা,রোববার, ১৭ নভেম্বর ২০২৪

পাকিস্তান প্রশ্নে বাংলাদেশ ভারতের পাশে, নেই চীন ও রাশিয়া!

hasina-modi-puthinবাংলাট্রিবিউন : গোয়াতে ব্রিকস্ সম্মেলন তথা বিমসটেক আউটরিচে সন্ত্রাসবাদ মোকাবিলার প্রশ্নে নরেন্দ্র মোদি শেখ হাসিনাকে পুরোপুরি পাশে পেলেও শি জিনপিং বা ভ্লাদিমির পুতিনেরও যে সর্বাত্মক সমর্থন পেলেন তা কিন্তু বলা যাচ্ছে না।

ভারতের গোয়াতে ব্রিকস নেতাদের শীর্ষ সম্মেলনের শেষ দিনে রবিবার ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বলেছেন, ‘সন্ত্রাসবাদ মোকাবিলায় বেছে বেছে এগোনোর কোনও সুযোগ নেই’। ইঙ্গিতটা যে চীনের প্রতিই ছিল, তা বুঝতে কারও অসুবিধা হয়নি।

ওই বক্তৃতায় প্রতিবেশী পাকিস্তানের নাম না-করেও নরেন্দ্র মোদি তাদেরকে ‘সন্ত্রাসবাদের আঁতুড়ঘর’ হিসেবে বর্ণনা করেছেন, কিন্তু ব্রিকস সম্মেলন শেষে যে গোয়া ডিক্লারেশন বা যৌথ ঘোষণাপত্র গৃহীত হয়েছে তাতে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ–কোনও ভাবেই পাকিস্তানের কোনও উল্লেখ নেই।

যা থেকে ধারণা করা হচ্ছে, সন্ত্রাসবাদের প্রশ্নে ভারতের যা ব্যাখ্যা, তাতে চীন বা রাশিয়ার মতো ব্রিকসের অন্য সদস্য দেশগুলোকে পুরোপুরি সহমত করাতে পারেনি তারা।

তবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিমসটেকে তাঁর বক্তৃতায় সন্ত্রাসবাদের নিন্দা করেছেন যে ভাষা ও ভঙ্গিতে, ভারত তাতে তাকে অকুণ্ঠ ধন্যবাদ জানাচ্ছে।

বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বলেছেন, বিমসটেকের এখন উচিত আগামী পাঁচ বছর আর সব কিছু ভুলে বাণিজ্য, জ্বালানি, কানেক্টিভিটি আর সন্ত্রাসবাদ-দমন এই চারটে বিষয়ে মনোযোগ কেন্দ্রীভূত করা।

সন্ত্রাসবাদ যে সব রকম রূপে আর আকারেই নিন্দনীয়, তা উল্লেখ করে তিনি আরও বলেছেন, “বাংলাদেশ সন্ত্রাসবাদ মোকাবিলার প্রশ্নে ‘জিরো টলারেন্স’ নীতি অনুসরণ করছে–এমনকি দেশের ভেতরেই গজিয়ে ওঠা জঙ্গিদের পুরোপুরি ছিন্নভিন্ন করে দিতেও সক্ষম হয়েছে।”

বাংলাদেশ যে তরুণদের মধ্যে জঙ্গিবাদের প্রসার রুখতে দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে সচেতনতা অভিযান চালাচ্ছে সে কথাও তিনি উল্লেখ করেছেন। কিন্তু ঢাকার এই মনোভারের সঙ্গে সুর মেলাতে দেখা যায়নি বেইজিং বা মস্কোকে। বিষয়টি তারা খানিকটা এড়িয়েই গেছে। মূলত ভারত শাসিত কাশ্মীরের উরিতে জঙ্গি হামলার পর থেকেই সন্ত্রাসবাদ মোকাবিলার প্রশ্নে ভারতের সঙ্গে চীন ও রাশিয়ার মতবিরোধের বিষয়টি অনেকটাই সামনে চলে আসে।

উরির হামলার জন্য ভারত সরাসরি পাকিস্তানকে দায়ী করলেও বেইজিং তাদের পুরনো মিত্র ইসলামাবাদের পাশেই দাঁড়িয়েছে, এমনকি জইশ-ই-মহম্মদের নেতা মাসুদ আজহারের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার ক্ষেত্রেও জাতিসংঘে ভারতের প্রস্তাব তারা আটকে দিয়েছে।

উরিতে হামলার পরও রাশিয়া পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর সঙ্গে তাদের নির্ধারিত যৌথ সামরিক মহড়া বাতিল করেনি, এ ব্যাপারে ভারতের নির্দিষ্ট অনুরোধ সত্ত্বেও।

ফলে উরির হামলার এক মাসেরও কম সময়ের ভেতর যখন গোয়াতে ব্রিকসভুক্ত দেশগুলোর শীর্ষ নেতারা মিলিত হন–ধারণা করা হয়েছিল সন্ত্রাসবাদ মোকাবিলার প্রশ্নে বিশেষত চীন ও রাশিয়াকে পাশে পেতে ভারত সর্বাত্মক চেষ্টা চালাবে।

বস্তুত স্বাগতিক দেশের সরকারপ্রধান হিসেবে নরেন্দ্র মোদি চীনা প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং ও রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন দুজনের সঙ্গেই আলাদা দ্বিপাক্ষিক বৈঠক করেছেন–এবং সন্ত্রাসবাদ নিয়ে প্রতিবেশী পাকিস্তানকে কঠোর আক্রমণ করতেও চেষ্টার কোনও ত্রুটি রাখেননি।

ব্রিকসের প্লেনারি অধিবেশনে মোদি বলেন, “আমাদের নাগরিকদের জীবনকে নিরাপদ করে তুলতে হলে নিরাপত্তা ও সন্ত্রাস-মোকাবিলার প্রশ্নে সহযোগিতার কোনও বিকল্প নেই। আমাদের উন্নয়ন ও আর্থিক সমৃদ্ধিতে সন্ত্রাসবাদ খুব লম্বা ছায়া ফেলে। এর বিরুদ্ধে প্রত্যেক দেশকে একা যেমন, তেমনি যৌথভাবেও লড়তে হবে। জঙ্গিদের অর্থায়ন, অস্ত্র সরবরাহ, প্রশিক্ষণ বা রাজনৈতিক সমর্থন–সব কিছুকেই সমূলে উৎপাটন করতে হবে।”

শুধু এটুকুই নয়, এর আগে ব্রিকস নেতাদের মধ্যে রুদ্ধদ্বার বৈঠকে তিনি এমনও মন্তব্য করেছেন যে ভারতের প্রতিবেশী এমন দেশও আছে যারা সন্ত্রাসবাদের আঁতুড়ঘর হিসেবে কাজ করছে–মোদির কথায় যারা হল ‘মাদারশিপ অব টেরোরিজম’।

পরে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ই তাকে উদ্ধৃত করে এ মন্তব্যের কথা জানিয়েছে। এমনকি সম্মেলনের সমাপ্তি ভাষণেও নরেন্দ্র মোদি দাবি করেছেন ব্রিকসের সব সদস্য দেশই এ ব্যাপারে একমত হয়েছে যে সন্ত্রাসে যারা মদত দেয় বা জঙ্গিদের আশ্রয় দেয় তারাও সন্ত্রাসবাদীদের চেয়ে কোনও অংশে কম বিপজ্জনক নয়।

কিন্তু মোদি প্রকাশ্যে যাই বলুন, এদিন বিকেলের পর ব্রিকসের সব শীর্ষ নেতা একমত হয় যে গোয়া ডিক্লারেশন বা গোয়া ঘোষণাপত্রের বিবৃতিতে সন্ত্রাসবাদের প্রশ্নে ভারতের এই কঠোর মনোভাবের বিশেষ একটা প্রতিফলন ঘটেনি। সেখানে এমন কিছুই নেই, যা থেকে মনে হতে পারে ব্রিকস সন্ত্রাসবাদের মদতদাতা হিসেবে পাকিস্তানের কোনও নিন্দা করছে।

তবে দীর্ঘ বিবৃতির একটি অনুচ্ছেদে ব্রিকস নেতারা সহমত হয়ে শুধু এটুকু বলেছেন, কোনও ধর্মীয়, জাতিগত, আদর্শগত, রাজনৈতিক বা অন্য কোনও কারণ দেখিয়েই সন্ত্রাসবাদের হয়ে সাফাই দেওয়া যায় না। ভারতসহ ব্রিকস দেশগুলোতে হওয়া সাম্প্রতিক জঙ্গি হামলাগুলোরও তারা নিন্দা করেছেন, তবে ‘উরি’ শব্দটার কোনও উল্লেখ করেননি।

শেখ হাসিনাও তার ভাষণে বলেছেন, “সন্ত্রাসবাদী ও তাদের সমর্থক– উভয়ের বিরুদ্ধেই আমাদের কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে। সন্ত্রাসবাদীদের যারা মদত দেয়, পরামর্শ দেয়, অর্থ বা প্রশিক্ষণ জোগায় কিংবা অস্ত্র হাতে তুলে দেয় তাদের সবার আগে খুঁজে বের করতে হবে।”

ভারত যে মন্তব্যের ব্যাখ্যা করছে এভাবে–তিনি হয়তো পাকিস্তানের নাম উল্লেখ করেননি, কিন্তু অবধারিতভাবে পাকিস্তানের কথাই বলতে চেয়েছেন!

 

পাঠকের মতামত: